শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:৪৪ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
কঠিন সময়ের চ্যালেঞ্জে বিএনপি

কঠিন সময়ের চ্যালেঞ্জে বিএনপি

স্বদেশ ডেস্ক:

বিএনপির অবস্থা অনেকটা পথহারা পথিকের মতো। কোন পথে এগোবেন তা নিয়ে দিশেহারা দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। বিদেশি ‘বন্ধুহীন’ বিএনপি শক্তিশালী কোনো রাষ্ট্রের সমর্থনও পাচ্ছে না। তাই কঠোর আন্দোলনেও সরকার পতন হবে এমন নিশ্চয়তা নেই। এমন পরিস্থিতিতে আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ের পর নির্বাচনে অংশগ্রহণ, নাকি আন্দোলনে না গিয়ে নির্বাচনের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি- এমন আবর্তে এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে তাদের সিদ্ধান্ত। ফলে নেতাকর্মীরাও দলের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছেন।

প্রতিষ্ঠার পর কয়েক দফা সংকটে পড়লেও এবারই কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়েছে দলটি। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে নিজেদের লক্ষ্য নির্ধারণ করে প্রয়োজনীয় কৌশল গ্রহণেও ব্যর্থ নীতিনির্ধারকরা। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারামুক্ত হলেও রাজনীতিতে একেবারেই নিষ্ক্রিয়। নিজ গৃহ থেকে বের হতে পারছেন না। দ- নিয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে রয়েছেন। দুই শীর্ষনেতার ‘অনুপস্থিতি’তে নেতৃত্বসংকট দৃশ্যমান।

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, অগোছালো বিএনপির সামনে কঠিন সময় আসছে। কারণ জাতীয় নির্বাচনের আগে প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পড়তে হবে তাদের। দলের অনেক নেতাকর্মীর মামলা বিচারাধীন, তাদের অনেকের সাজা হতে পারে বছরখানেকের মধ্যেই। তাই যদি হয়, তা হলে আন্দোলনের মাঠে দল নেতৃত্বসংকটে পড়বে। দুই বছরের বেশি সাজা হলে অনেক জ্যেষ্ঠ ও মধ্যম সারির নেতা নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হবেন।

টানা তিন দফায় ১৪ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির নেতাকর্মীরা অনেক আগে থেকেই কোণঠাসা। করোনাকালে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত রেখেছিল দল। তবে সারাদেশে হেল্প সেন্টার গঠন করে সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে। এখন বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কমিটি গঠনের মাধ্যমে দলকে আন্দোলন ও নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে হাইকমান্ডের দৃশ্যমান কিছু তৎপরতা থাকলেও আশার আলো দেখছেন না নেতাকর্মীরা। কারণ, কমিটি গঠনের মাধ্যমে যে নেতৃত্ব উঠে আসছে তা নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে।

ওয়ান-ইলেভেনের পর বেশ কয়েকবার সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করে ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছে বিএনপি। প্রতিবারই হোঁচট খেয়েছে। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যানের পর বড় আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি দলটি। ওই নির্বাচনে অবিশ্বাস্য পরাজয়ের পর নেতাকর্মীদের হতাশা তৈরি হয়েছে।

এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপির ৪৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীদের আশা-আকাক্সক্ষার কেন্দ্র হিসেবে বিএনপি গঠন করেন। এরপর দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম আর বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে দেশ শাসন ও বিভিন্ন চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে বিএনপি। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এই দলটি দীর্ঘসময় ধরে পালন করে চলছে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা। দিনটি উপলক্ষে একদিনের কর্মসূচি হাতে নিয়েছে বিএনপি। সংবাদপত্রগুলোয় ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হবে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে এক লক্ষাধিক মামলা চলছে। ৩৫ লাখের বেশি মানুষ আসামি। গুম করা হয়েছে পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী, খুন হয়েছেন হাজারের অধিক এবং অত্যাচার-নির্যাতনের শেষ নেই।

তিনি বলেন, ২০০৮ সাল থেকে দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন নেই। ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ দেশের মানুষের ভোটাধিকার, বাকস্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হামলা, গুম ও খুন করে একদলীয় শাসন কায়েম করেছে। এই সংকট বিএনপির একার নয়, গোটা রাষ্ট্রের। এ থেকে উত্তরণের জন্য জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে আন্দোলনের বিকল্প নেই। সে ক্ষেত্রে আন্দোলন গড়ে তোলাই বিএনপির এখন মূল চ্যালেঞ্জ।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপিকে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে। সামনের দিনে বিএনপিকে বিদেশি রাষ্ট্রের সমর্থন আদায় করতে হবে। কিন্তু দীর্ঘদিনের মিত্র চীনের সঙ্গে বিএনপির সেই সখ্যতা নেই। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো থাকলেও বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। পাকিস্তানেরও প্রভাব কমেছে দেশের রাজনীতিতে। আর ভারত এখনো বিএনপিকে বিকল্প হিসেবে ভাবনায় আনেনি। এর সঙ্গে যুক্ত হবে নেতাকর্মীদের সাজার বিষয়। আগামী নির্বাচনের আগে অনেক নেতাকর্মীকে সাজা দেওয়া হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করে আসছেন দলের নীতিনির্ধারকরা। আর আন্দোলন সফল হওয়ার মতো সাংগঠনিক শক্তিও তেমন নেই। হতাশাগ্রস্ত নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করার মতো কোনো কর্মসূচিও নেয়নি দল।

বিএনপির অন্তত তিনজন নীতিনির্ধারক আমাদের সময়কে বলেন, বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতি কী হবে তা তাদের কাছে স্পষ্ট নয়। এ বিষয়ে দলের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কোনো আলোচনা হয়নি। আন্দোলন করতে হলে কিছু কৌশল ঠিক করতে হয়, সেটিও চূড়ান্ত নয়। নির্বাচনে গেলে দলকে নির্বাচনমুখী করতে কিছু পদক্ষেপ নিতে হয়, সেটিও দৃশ্যমান নয়।

এ সমন্বয়হীতার পেছনে দলের কেউ কেউ নেতৃত্বসংকটকে দায়ী করেছেন। লন্ডন থেকে তারেক রহমান স্কাইপের মাধ্যমে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করলেও এতে অনেক অসঙ্গতি রয়েছে। কারণ, তার শারীরিক অনুপস্থিতির কারণে সিদ্ধান্তগুলো প্রশ্নবিদ্ধ থাকছে। কমিটি গঠনের মাধ্যমে এমন নেতৃত্ব আসছে যাদের সবাইকে দক্ষ ও যোগ্য মনে করতে পারছেন না অধিকাংশ নেতাকর্মী।

নানা হিসাব-নিকাশ করে আপাতত দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। তবে ব্যক্তিগত পছন্দ কিংবা সিন্ডিকেটের বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত হচ্ছে না। জ্যেষ্ঠ নেতাদের সবাই খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব চান। সক্রিয়ভাবে না হলেও অন্তত দলের নীতিনির্ধারণী বিষয়ে তার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক- এমন প্রত্যাশা তাদের। তবে সে পথে বাধা হয়ে আছে দলের বিবদমান গ্রুপগুলো।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মনে করেন, বিএনপি রাজনীতি করছে না, ঘরে বসে আছে- এটাই মূল সংকট। সরকার তাদের একটি করে ইস্যু দেয় তারা তার পেছনে ছুটে বেড়ায়। তারা গণমুখী আন্দোলন করে না। দলীয় নেত্রীর জন্য মাঠে নামে না। বিএনপিকে সংগঠন করতে হবে, রাজপথে নেমে আন্দোলন করতে হবে। এটাই তাদের সংকট উত্তরণের একমাত্র পথ।

১৯৭৭ সালের জুন মাসে প্রেসিডেন্ট জিয়া ১৯ দফা র্কমসূচি নিয়ে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক (জাগো) দল গঠন করেন। ওই দলের আহ্বায়ক ছিলেন বিচারপতি আবদুস সাত্তার। এরপর জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠন করে জিয়াউর রহমান ওই বছর প্রত্যক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। এর পর ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর রমনা বটমূলে জাতীয়তাবাদী দলের জন্ম হয়। জাগো দল, ন্যাপ (মশিউর রহমান যাদু মিয়া), ইউনাইটেড পিপলস পার্টি (ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম-আকবর হোসেন), লেবার পার্টি (মতিন) ও মুসলিম লীগ (শাহ আজিজুর রহমান) নিয়ে বিএনপির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিল। সর্বসম্মতভাবে প্রেসিডেন্ট জিয়াকে দলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়।

জিয়াউর রহমানকে হত্যার পর নেতাকর্মীদের অনুরোধে গৃহবধূ খালেদা জিয়া রাজনীতিতে আসেন। ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদ লাভ করেন তিনি। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল এরশাদ সামরিক শাসন জারি করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এ দুঃসহ অবস্থায় সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে যান খালেদা জিয়া। ’৮৩ সালের মার্চে খালেদা জিয়া বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। স্বৈরশাসকবিরোধী আন্দোলনের একপর্যায়ে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব নেন তিনি। ১৯৮৪ সালের ১০ মে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। আজ অবধি তিনিই চেয়ারপারসনের পদে বহাল রয়েছেন।

জনপ্রিয় এই দলটি চারবার সরকার গঠন করে। জিয়াউর রহমানের সরকারের পর ১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের পর তিন জোটের রূপরেখার আলোকে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনেও বিএনপি জয়লাভ করে। সর্বশেষ ২০০১ সালের ১ অক্টোবর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়লাভ করে।

অবশ্য বিএনপি গঠনের ৪৩ বছর পরে এসে দলের সিনিয়র নেতা ও বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জিয়াউর রহমানের আদর্শ থেকে অনেকটাই সরে এসেছে দল। সৎ, যোগ্য, ত্যাগী ও মেধাবী নেতাকর্মীরা এখন দলের প্রথম কাতারে আসতে পারছেন না। উদার গণতান্ত্রিক ভাবধারার অবস্থান থেকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রভাব বেড়েছে দলের ভেতরে। জামায়াতে ইসলামীর মতো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ বিএনপি দেশ-বিদেশে সমালোচনার মধ্যে পড়েছে। তাদের সঙ্গ ছাড়া নিয়ে দলের ভেতরে নানা আলোচনা হলেও তা এগোয়নি।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে পৃথক বাণী দিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও দলীয় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি

আজ বুধবার ভোর ৬টায় নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলীয় পতাকা উত্তোলন, বেলা ১১টায় সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যবৃন্দের ফাতেহা পাঠ ও পুষ্পস্তবক অর্পণ, বেলা সাড়ে ১১টায় ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির নেতৃবৃন্দের ফাতেহা পাঠ ও পুষ্পস্তবক অর্পণ। দুপুর ১২টায় কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ড্যাবের সহযোগিতায় হেলথ ক্যাম্প এবং করোনা রোগীদের জন্য ওষুধ ও সুরক্ষাসামগ্রী বিতরণ। ২ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টায় জাতীয় প্রেসক্লাবে বিএনপির উদ্যোগে আলোচনাসভা। সারাদেশে জেলা, মহানগর, উপজেলা, থানা, পৌরসহ বিভিন্ন ইউনিটে দলীয় কার্যালয়ে দলীয় পতাকা উত্তোলন, আলোচনাসভাসহ অন্যান্য কর্মসূচিও রয়েছে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877